সন্ন্যাসী তান্ত্রিক ও জিন
-সৌমেন সরকার
সে অনেক বছর আগের কথা।
যখনকার কথা বলছি তখন আমি ক্লাস ইলেভেনের ছাত্র। মাধ্যমিক পাশ করার পর ভালো ছাত্রদের মধ্যে প্রায় সবাই রাখালদাস হাই স্কুল ছেড়ে অন্যান্য স্কুলে অ্যাডমিশন নিয়েছে। আমি আর আমার বন্ধু নিতাই পণ্ডিত থেকে গেছি। ক্লাস সেভেন থেকেই ওর সাথে আমার নিবিড় ও প্রগাঢ় বন্ধুত্ব।
একদিন ওর বাবা নিমাই পণ্ডিত মহাশয়ের নিমন্ত্রণে গেলাম ওদের বাড়ী। ছয়ঘরিয়া অঞ্চলেই,তবে মেন রাস্তা থেকে একটু ভিতরে। এখন যেখানে সৎ সংঘের মন্দির ওখান থেকে একটু এগিয়ে ডান দিকে। রাখালদাস বন্দ্যোপাধ্যায়ের বাড়ির ওখানে। নিমাই বাবু মানুষটি কিন্তু অমায়িক প্রকৃতির। পুরোটা সাধু-সন্ন্যাসী না হলেও মহারাজ ব্যক্তি। শিষ্যটিষ্য অনেক আছে শুনেছি। তবে তেমন জাঁদরেল পোশাক আশাক পরেননা। ওনার মতে,উনি একজন সাধারণ মানুষ।ভগবান আর আর পাঁচজন সাধারণ মানুষের মধ্যে যোগাযোগ স্থাপনের কাজটি করেন শুধু। সাধারণ ধুতি-পাঞ্জাবী পরেন।কপালে তিলক বৈষ্ণব স্টাইলে টানা, আর চুল একটু বড় বড়। আলাপ হল নিতাই এর মায়ের সাথেও।এককথায় পারফেক্ট ফ্যামিলি।
সেখানেই নিমাই বাবুর মুখে সন্ন্যাসী তান্ত্রিকের যে বিচিত্র ও আশ্চর্য কাহিনী শুনেছিলাম তা কোনদিনই ভুলবনা। আগে অবশ্য নিতাই এর কাছে সন্ন্যাসী তান্ত্রিকের নাম শুনলেও এতটা জানতাম না।
তখন রাত প্রায় দশটা। এখনকার মত অতটা আলোর ব্যবস্থা ছিলনা। তাই রাতে আমাকে বাড়ী ফিরতে দেননি। আমিও বাড়ী ফেন করে সেকথা জানিয়ে দিয়েছিলাম। ডিনার শেষ করে আমরা সবাই ছাদে এসে বসলাম। সময়টা কালীপূজোর পর,অগ্রহায়ণ মাস। তাই শীত ততটা পড়েনি। চারদিক খোলা ছাদ হলেও বসা ও বিশ্রামের জন্য ছাউনি দেওয়া আছে। একটা খাটিয়াও পাতা আছে ছাউনির নীচে। অনায়াসেই তিনজন সেখানে বসা যায়। খাটিয়ার একপাশে নিমাই বাবু আর অন্যদিকে আমি আর নিতাই গায়ে গায়ে ঘেঁসাঘেসি করে বসেছি। তখনও কিন্তু আমি পুরোপুরি সাহিত্যিক হইনি। কিছু কবিতা আর গল্প প্রকাশিত হয়েছে মাত্র। আর “নীলাঞ্জণা” খানা শেষ করেছি সবেমাত্র।
যাক,সেসব কথা থাক। সন্ন্যাসী তান্ত্রিক নিয়ে গল্প লিখতে বসে এটুকু ভূমিকা করে এবার আসা যাক মূল কাহিনীতে।
পরস্পরের পরিবারের কথা আলোচনা,কুশলপ্রশ্নাদি সমাপ্ত হলে নিতাই ওর বাবাকে জানিও দিল যে আমি লেখালিখি করি। আর প্যারানরমাল বিষয়ে আমার আকর্ষণ প্রবল। তাই শুনে নিমাই বাবু হাসিমুখে বললেন-“শোন বাবা সৌম্য! শুধু লিখলেই হয়না। যা লিখবে তার সাথে যদি বাস্তবের মিল না থাকে তবে পাঠক সেই লেখার সাথে নিজেদের খাপ খাওয়াতে পারবেনা। আর প্যারানরমাল বা ভৌতিক গল্পের ক্ষেত্রে তো কথাটা আর জটিল।”
-“কিরকম? ঠিক বুঝলাম না কাকু!” আমি প্রশ্ন করলাম।
উনি বললেন-“কোনো সত্যি ঘটনা থেকে গল্পের বীজ বপন করলে পরে তাতে রং চড়িয়ে লিখলেও কোন ক্ষতি হয়না। বরং তা আরও বাস্তব হয়ে ওঠে। আর ভৌতিক গল্পের ক্ষেত্রে শুধু কঙ্কাল,ভূত আর গয়ায় পিণ্ড দান করলেই গল্প হয়না। সেখানেও অজস্র জানার বিষয় আছে,আছে আজস্র নিয়ম কানুন। সব জানলে এত গল্প লিখতে পারবে যে কয়েকখানা বই বের করতে পারবে।”
আমার মেরুদণ্ড সোজা হয়ে গেল। উনি একথা বলে একটু চোখটিপে হাসলেন। আমিও উদ্গ্রীব হয়ে অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছি তার দিকে। উনিই আমার বড় নামখানা ছোট করে সৌম্য করে নিয়েছেন।আর এই নামটা নাকি আমার সঙ্গে ভালো যায়। আমার ভালো লাগল নতুন নাম পেয়ে।
ইতিমধ্যে নিতাই এর মা এসে সবাইকে একবাটি করে মিষ্টি দই আর গোটা পাঁচ-ছয়টা করে রসগোল্লা দিয়ে গেছেন। নিমাই বাবু ইশারায় সেগুলি খেতে বললেন।আমরা খাওয়া শুরু করলাম। আমার ঔৎসুক্য দেখে উনিও আর ভণিতা না করে বললেন-
“শোন তবে। আজ তোমাদের এমন একজনের কাহিনী শোনাব যাকে স্বচক্ষে না দেখলে বিশ্বাসই হবে না যে তিনি একজন পিশাচসিদ্ধ তান্ত্রিক। আমরা তাঁকে সন্ন্যাসী তান্ত্রিক বলেই চিনতাম। তিনি ছিলেন আমার বাবার বন্ধু।
তখনও আমরা এদেশে আসিনি। থাকতাম কুমিল্লা থেকে চোদ্দ-পনের কিলোমিটার ভিতরে একটা গ্রামে।গ্রামের নামখানা এই মুহূর্তে মনে পড়বে না,কারণ তখন আমার বয়স আট কি দশ বছর। আমি তাঁকে খুড়ো বলেই ডাকতাম। থাকতেন আমাদের বাড়ী থেকে তিনটে বাড়ী পর পাল বাবুদের নীচের দুখানা ঘর ভাড়া নিয়ে।এখন এখানেই আছেন,উদয়পুরে। আমরা আলে আসার বছর খানেকের মধ্যে উনিও চলে আসেন।পরিবার বলতে এক ছেলে কিশোর,এক মেয়ে শকুন্তলা আর স্ত্রী পদ্মা,মানে পদ্মাবতী। তবে তারা কেউই বেঁচে নেই। ওনাদের প্রত্যেকের মৃত্যুর পশ্চাতে একটা করে ভয়ানক কাহিনী আছে! সেসব অন্যদিন বলব। তখন বয়স বত্রিশ কি তেত্রিশ হবে।
প্রায় ছয়ফুট লম্বা,ফর্সা,দীর্ঘ বলিষ্ট পেশিবহুল চেহারা।গলায় আর দুহাতের বাইসেপস ও ট্রাইসেপস জুড়ে আছে মোটা মোটা রুদ্রাক্ষের মালা। বড় বড় না কাটা চুল জটায় রুপান্তরীত হয়েছে। গোঁফদাঁড়ি লম্বা,তবে মাঝে মাঝে ছাঁটা হয়। দুচোখ জবা ফুলের মত টকটকে লাল! প্রথমদিকে ভয়ে বাবার কোলে ভয়ে সিঁটিয়ে থাকতাম। কিন্তু পরে সে ভয় কেটে গিয়েছিল। উনি আমাকে নিজের ছেলের মতই ভালোবাসতেন,স্নেহ করতেন। তাঁর কোন শিষ্য বা চেলাচামুণ্ডা ছিলনা। একাই রেঁধে খেতেন। বেশ কিছু বছর পর থেকে আমি একাই ওখানে যেতে শুরু করলাম। বিভিন্ন গল্পের মধ্যে একদিন আমি বললাম যে আমারও তন্ত্রবিদ্যার প্রতি প্রবল আকর্ষণ। তা শুনে তিনি ধমক দিয়ে বললেন-
“হতচ্ছাড়া! সংসারী হ! এপথে আসিসনা,পারবিনা। তোর কপালে যে সংসার সুখ আছে।”
কিন্তু আমিও ছাড়বার পাত্র নয়। শেষে আমার পীড়াপীড়িতে নিমরাজি হলেন। তবে তন্ত্রবিদ্যা যে আমার কপালে সইবেনা তা প্রথমেই বলে দিয়েছিলেন।তিনি আমাকে কিছু সাধনপদ্ধতি শিখিয়েছিলেন পরে ধীরে ধীরে। যার জন্য আমি পরে এই মহারাজের জীবনযাপন করতে পারছি। গুরু হয়ে শিষ্যদের সঠিক পথ দেখাতে পারছি। সেসব কথা অন্যসময় বলবো।এখন আসল কথা শোন।
একদিন আমায় ডেকে বললেন-
“শোন্ নিমাই, আগামী শনিবার মহাব্রত যোগ আছে।দুর্গাষ্টমী তিথিতে ঐদিন রাতে এক বিশেষক্ষণে জিন নামাবো! থাকিস,ভাল অভিজ্ঞতা হবে তোর। ভবিষ্যতে বিশেষভাবে উপকৃত হবি। আর তার সাথে সাথে তোর মাথা থেকে তন্ত্রবিদ্যার ভূতও হয়তো ঝেড়ে যাবে। বুঝবি এগুলো স্রেফ আগুন নিয়ে খেলা ছাড়া আর কিছুই না!”
আমি বিষয়টাকে ততটা গুরুত্ব দিলাম না। জিন নামাবে!হয় নাকি কখনও? এসব গাঁজা আর কলকে ভেবে বেজায় হাসি পেল আমার। তবে যেতে তো হবেই। ভাবছি বাবাকেও সঙ্গে নিয়ে যাব। বাবাকে বলতেই তিনি জানালেন,সন্ন্যাসী খুড়ো তাকে আগেই সব জানিয়েছেন। আমরা একসাথেই যাব।
যতই ডানপিটে স্বভাব হোক না কেন জিন নামানোর মত এমন একটা অলৌকিক ঘটনার সাক্ষী হবো একথা চিন্তা করেই সমস্ত শরীর আমার রোমাঞ্চিত হয়ে উঠল।কি জানি কি হবে?
দুর্গাষ্টমীর সন্ধ্যা।
সময়টা শীত নয়। ঠিক কোন মাস তা খেয়াল নেই তবে গরমের ভাব তখনও কিছুটা আছে। আমি আর বাবা স্নান করে নতুন বস্ত্র পরে শুদ্ধাচার মেনে চললাম খুড়োর বাড়ী। এই স্নান করা ও শুদ্ধাচারের প্রক্রিয়া অবশ্য উনি আগেই আমাদের বলে দিয়েছিলেন।
গিয়ে দেখি যজ্ঞ প্রস্তুত। ঘরের ঠিক মাঝখানে ইঁট,কাদা মাটি ইত্যাদি দিয়ে বেশ বড়ো একটা যজ্ঞের বেদী করা হয়েছে। তার একপাশে বসে খুড়ো শেষ বারের মত যজ্ঞের সবকিছু তত্ত্বাবধান করে নিচ্ছেন। যজ্ঞবেদীর অন্যপাশে পাঁচটা কাঠের পিড়ি পাতা,আর তার পিছনে প্রায় সারা ঘর জুড়ে খেজুর পাতার তৈরী পাটি পাতা আছে যাকে চাটাই বলে। বারান্দায়ও প্রায় সারা বারান্দা জুড়ে চাটাই পাতা। কিছুক্ষণ পর খুড়ো দুচোখ বুজে পদ্মাসনে বসলেন ও বিড়বিড় করে কিসব মন্ত্র আওড়াতে লাগলেন। মিনিট পাঁচেক এভাবে থাকার পর লাল টকটকে চোখ খুলে তীব্র ঝাঁঝালো বাজখায়ী কণ্ঠে বললেন-
“আজ দুর্গাষ্টমীর মহাব্রত তিথি। আমি জিনকে আহ্বান করব। গ্রামে যার যা সমস্যা আছে,যা রোগব্যাধি আছে একে একে এসে বলবে। সবাইকে সমস্যা থেকে মুক্তি দেবে সে। সবাই সুস্থ হয়ে ঘরে ফিরে যাবে। কিন্তু সাবধান! কয়েকটা বিষয়ে কড়া ভাবে তীক্ষ্ণ লক্ষ্য রাখতে হবে। পাঁচজন করে পিঁড়িতে বসবে। তারা প্রত্যেকে পদ্মাসনে বসবে। পিঁড়ি বেশ বড় আছে,কোন সমস্যা হবেনা। এবার আসল বিধিটা শোন সবাই।”
আমরা ঘরেই ছিলাম। তবে একপাশে কোণের দিকে।খুড়োর দিকে কেউই থাকার নিয়ম নেই। একথা বলার পর চাপা উত্তেজনাপূর্ণ কথাবার্তা থেকে অন্যদিকে তাকিয়ে দেখি গ্রামের লোকর ভিড়ে ঘর-বারান্দা প্রায় ভরে গেছে। খুড়ো কোনো দিকে নজর না দিয়ে বলে চললেন-
“দুহাতের বুড়ো আঙুল দুটোকে বাকী আঙুলের মধ্যে আবদ্ধ করে মুষ্ঠী তৈরী করে হাঁটুর ওপর সোজা ভাবে রাখতে হবে। যাতে তেলোর দিকটা নীচে থাকে। বাকী যারা আছে সবাইকে বজ্রাসনে বসতে হবে। আর তারাও ঠিক একই ভাবে মুষ্ঠী করে একই ভঙ্গীতে বসবে।সাবধান! যতক্ষণ প্রক্রিয়া সমাপ্ত না হয় এবং জিন বিদায় না হয় কেউই কিন্তু আসন ছেড়ে উঠতে পারবে না। উঠলেই চরম বিপদ! আর হাতের বদ্ধ মুষ্ঠী খুললে বসে থাকা পিঁড়ি বা যজ্ঞের বেদীর ইঁট সটান পড়বে মাথার ব্রহ্মতালুতে। খুব সাবধান! করে দিচ্ছি কিন্তু আগে থেকেই। যাদের সমস্যা আছে তারা শীঘ্রই এবাড়ীর সীমানার বাইরে চলে যাও। পরে কিন্তু কিছু হলে আমার কোন দায়বদ্ধতা থাকবেনা এই বলে দিলাম।”
যাই হোক,ডানপিটে ডাকাবুকো হলেও বুক যে একটু দুরুদুরু করছিল তা স্বীকার করতে লজ্জা নেই। বুকের মধ্যে যেন ঢিপঢিপ করতে শুরু করল। তবুও কি হয় কি হয় এই প্রবল ইচ্ছাকে সেই বয়সেও দমিয়ে রাখতে পারলাম না। দেখাই যাক না কি ঘটে। চারিদিকে একবার তাকিয়ে দেখি লোকে লোকারণ্য অবস্থা!অনেকে স্থানাভাব হেতু বাড়ি থেকে বসার জিনিস এনে স্থান দখল করেছে। বুঝলাম,এসব খুড়োর বুজরুকি নয় হয়তো। সকলেই জানেবও মানে সন্ন্যাসী তান্ত্রিকের ক্ষমতাকে। তাই স্বভাবতই আমার মনেও তার জন্য শ্রদ্ধার উদ্রেক হল। এবার আসল মুখ্য ঘটনার জন্য অপেক্ষা করা যাক।
সবাই বসলাম খুড়োর নির্দেশ মত। তিনি ততক্ষণে যজ্ঞ শুরু করে দিয়েছেন। যজ্ঞের বেদীর তিনটি পর্বে বা সারিতে চারিদিক ঘিরে প্রদীপ জ্বালানো। একটা বড় পিলসুজের ওপর বড় প্রদীপ জ্বলছে খুড়োর ডানপাশে।চারিদিকে যেন অপার্থিব নিস্তব্ধতা বিরাজমান। শুধু খুড়োর মন্ত্রপাঠ শোনা যাচ্ছে। এবার সত্যি সত্যিই কিন্তু আমার একটু ভয় করতে লাগল। ততক্ষণে এক অন্য বিপর্যয় শুরু হয়েছে। কোথাও ঝড় নেই,বাতাস নেই;তবুও যেন ঝড়ের মহা রণতাণ্ডব শুরু হয়েছে। আর সেই তাণ্ডব কেমন মাত্র খুড়োর বাড়ীর মধ্যেই সীমাবদ্ধ।গাছপালা যেন ভেঙে গুঁড়িয়ে পড়ছে। সন্ন্যাসী তান্ত্রিক তখনও চোখ বন্ধ করে মন্ত্রপাঠ থামিয়ে আমাদের উদ্দেশ্যে চেঁচিয়ে বলে চলেছেন-
“কেউ ভয় পেয়ে হাত খুলবেন না বা আসন ত্যাগ করবেন না। আমি জিন আহ্বান করেছি,সে আসছে।একটু পরেই সব শান্ত হয়ে যাবে। যা বলছি তাই করো সবাই, নইলে তোমাদের সাথে সাথে বিপদ আমারও।জিন আহ্বান করে কোন কাজ না করিয়ে তাকে অপমান করলে সে যে কোন একজনকে মেরে তার আত্মাকে সঙ্গে করে বন্দী বানিয়ে নিয়ে যাবে। তাই গোলমাল না করে আর ভয় না পেয়ে শান্ত হয়ে বসো সবাই।”
দেখলাম ম্যাজিকের মত খুড়োর বক্তৃতা শেষ হতে না হতেই সব ঝড়তুফান একেবারেই থেমে গেল। আবাক দৃষ্টিতে আর একটা ঘটনা দেখে আমার বুকের রক্ত নিমেশে শুকিয়ে গেল! দেখলাম ঝড় থামার সাথে সাথেই বেদীর তিন পর্বে সাজানো প্রদীপগুলো সব একসাথেই নিভে গেল। মনে হল যেন একটা ফুঁ দিয়ে কেউ প্রদীপগুলোকে নিভিয়ে দিয়েছে। আর তখনই আর একটা আশ্চর্য জিনিস দেখে ভয়ে মেরুদণ্ড বেয়ে যেন বরফগলা জলের একটা স্রোত প্রবাহিত হয়ে গেল।দেখলাম একটা প্রকাণ্ড দেহধারী কি একটা জীব খুড়োর পাশে বসল। খুড়োর ডানপাশে পিলসুজের ওপর রাখা প্রদীপটা আশ্চর্যজনকভাবে তখনও জ্বলছে। তার মৃদু আলোয় সেই বিশাল লোমশ দেহটা বোঝা গেলেও তার মুখটা আঁধারে আবৃত ছিল।কারণ,তার দেহটা এতটাই বিশাল যে সন্ন্যাসী তান্ত্রিকের ছয়ফুট দেহের প্রায় দ্বিগুণ বলে মনে হল। তার বসার হাবভাব দেখে মনে হল যে সে খুড়োর বশবর্তী হয়ে কাজ করলেও স্বেচ্ছায় আসেনি। অর্থাৎ,কোন পান থেকে চুন খসা ঘটনা ঘটলেই মহাবিপদ! খুড়ো বললেন-
“জিন প্রস্তুত! তোমাদের যা যা সমস্যা তাড়াতাড়ি আমার বলা নিয়মমত জানাও। ওর হাতে সময় কিন্তু একদমই কম।”
পাঁচজন করে পিড়িতে বসে বলতে লাগল তাদের সমস্যা। এতক্ষণ খেয়াল করিনি যে জিনের পাশে গোটা ডজন খানেক ফলের ঝুড়ি ছিল। জিন সেখান থেকে গবগব করে ফল খাচ্ছে আর একএককরে সমস্যা শুনে একটা করে ফল প্রত্যেকের দিকে ছুঁড়ে দিচ্ছে বিড়বিড় করে কিসব মন্ত্র বলে। খুড়ো তখন সেই ফল খাবার নিয়ম বলে দিচ্ছেন। প্রত্যেককে অনুরোধ করলেন পথে কারও সাথে কথা না বলতে আর বদ্ধ মুষ্ঠী একেবারে বাড়ী গিয়ে খুলে গঙ্গাজল দিয়ে শুদ্ধ হয়ে নিতে। কথার অন্যথা হলেই চরম বিপদ। সকলেই খুড়োর আদেশ মেনে মাথা নীচু করে ফল নিয়ে বাড়ীর দিকে যেতে শুরু করল।
প্রায় পঞ্চাশ-ষাট জন এভাবে চলে যাওয়ার পর কিন্তু হঠাৎ সবকিছু যেন নিস্তব্ধ হয়ে গেল। দপ্ করে খুড়োর ডানদিকে পিলসুজের ওপর জ্বলা বড় প্রদীপটা নিভে গেল। আর ওদিকে বিকট হুঙ্কার ছেড়ে জিনটা উঠে দাঁড়াল। সন্ন্যাসী খুড়ো তাড়াতাড়ি ব্যস্তসমস্ত হয়ে বললেন-
“সর্বনাশ! এখানে কেউ হাতের বুড়ো আঙুল খুলে জিনকে মুক্ত করেছে। কে এতবড়…”
শুধু এটুকুই শুনতে পেয়েছিলাম। তারপর যা ঘটতে শুরু করেছিল তা ভাবলেও আমি কথা হারিয়ে ফেলি। তার কথা শেষ হতে না হতেই ঘরের মধ্যে মৃদু একটু টাইফুন বয়ে গেল যেন! খটাস্ খটাস্ খটাস্ করে তিনটে কিসের যেন আওয়াজ কানে এল। ওদিকে যারা বাকি ছিল তারা চেঁচামেচি করতে করতে ছুটোছুটি করতে শুরু করেছে প্রাণের ভয়ে। কেউ পালিয়েছে,কেউ পালাচ্ছে কেউবা হোঁচট খেয়ে পড়ে আবার উঠে একদিনে চম্পট দিচ্ছে। সে এক বিচিত্র অবস্থা। পাশে থপাস করে কিসের একটা পতন হতেই বুঝলাম বাবা মাটিতে লুটিয়ে পড়েছেন। তখন ভয়ে আমার দেহে আর যেন এক ফোঁটা প্রাণও বাকী নেই। আমি জ্ঞান হারালাম অচিরেই।
জ্ঞান হতে দেখলাম আমি কুমিল্লা সরকারি হাসপাতালের বেডে শুয়ে আছি। না,আমার কোনরকম আঘাত লাগেনি। কিন্তু খবর পেলাম সন্ন্যাসী তান্ত্রিক আর বাবার মাথায় তিনটে করে সেলাই পড়েছে। আর পাশের গ্রামের একজন মারা গেছেন। ওই স্পট ডেড আর কি। পুরো ঘটনাটা জানলাম সপ্তাহ খানেক পর, যখন সকলে সুস্থ হয়ে বাড়ী ফিরে এসেছে। বাবাকে নিয়ে খুড়োর বাড়ী গেলাম। আর সেখানে যা শুনলাম তাতে গায়ের সবকটা রোম আমার খাঁড়া হয়ে উঠল!খুড়ো বললেন-
“যখন জিনটা ওভাবে বিকট চিৎকার শুরু করেছিল তখনই বুঝেছিলাম কেউ শয়তানি করে বদ্ধ মুষ্ঠি খুলে জিনকে মুক্ত করেছে। বুঝতে পারলে না হয়তো। দাঁড়াও আর একটু খোলসা করে বলি। জিন আহ্বানের পর আমি সকলের মুষ্ঠী বন্ধ করে মন্ত্র পড়ে জিনকে আবদ্ধ করি। সঙ্গে সকলের গাত্রবন্ধনও করে দিই। তারপর সেবার কাজ সমাপ্ত হলে জিনলোকে পাঠিয়ে তারপর বন্ধন মুক্ত করি। তাইতো সকলকে বাড়িতে গিয়ে মুষ্ঠি খুলতে বলি। কিন্তু কেউ যদি তার আগেই শয়তানি কারে মুষ্ঠি খুলে ফেলে তাহলে সকলের ওপরেই ঘনিয়ে আসে চরম বিপদের কালো ছায়া। কি অঘটন ঘটে তা তো আগেই বলেছি।”
আমি বললাম-“কিন্তু যে মারা গেল সেই বা কে? তাকে তো…”
খুড়ো হেসে বললেন-“ও হোলো কালু গুনিন। আমার গুরু ভাই ও চিরশত্রু! আমরা একগুরুর শিষ্য হওয়া সত্ত্বেও ও কিছুই শেখেনি। আমার তন্ত্র সাধনার পথে বাধাবিপত্তি সৃষ্টি করাই ওর জীবনের একমাত্র লক্ষ্য।বহুবার আমার চরম ক্ষতি করার চেষ্টা করেছে কিন্তু সফল হতে পারেনি। আর এবার হল হিতে বিপরীত।তাছাড়া আমি বুঝতে পারলেও কিছু করার আগে মাথায় ইঁটের খোঁচা খেলাম। ওটাকে হাত দিয়ে ছুঁড়ে ফেলতে গিয়ে পড়ল তোমার বাবার মাথায়। ক্ষমা করে দিও,ক্ষমা করে দিও তোমরা। অন্ধকারে কিছু বুঝতেই পারিনি। চিনতেও পারিনি যে ওটাই হতচ্ছাড়া কালু গুনিন।”
আমি লজ্জিত হয়ে বললাম-“আরে নানা,তার কোন দরকার নেই। বেঁচে আছি এই অনেক।”
বাবাও অনেক ধন্যবাদ দিলেন তাকে।”
তারপর নিমাই বাবু একটা দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলে বললেন-“তারপর কোথায় যে তিনি চলে গেলেন! আর দেখা হয়নি। তার কিছুকাল পর এদেশে পাকাপাকিভাবে চলে আসি।”
কখন যে রাত এগারটা বেজে গেছে খেয়ালই করিনি।তেমন শীত না পড়লেও আমি আর নিতাই ঠকঠক করে কাঁপছি। নিমাই বাবু বললেন-“ঠিক আছে,অনেক রাত হয়েছে। এখন তোমরা ঘুমিয়ে পড়ো। আবার এসো সময় করে,এমনসব অনেক গল্প হবে।”
সেরাতে তেমন ঘুমই হয়নি। পরদিন সকাল কিছু খেয়ে নিয়েই সাইকেল নিয়ে বাড়ীর উদ্দেশ্যে দৌড় দিই। যাকে ভালো বাংলায় চম্পট বলা যায়। যা শুনেছি হুবহু লিখলাম। এখন বিশ্বাস করা বা না করা পুরোপুরি তোমাদের মর্জির ওপর নির্ভরশীল। তবে আমি ধোঁয়াশার আবরণে আবৃত সব কুহেলী এখন কিন্তু বুঝতে পেরেছি। আসলে কালু গুনিন সন্ন্যাসী তান্ত্রিককে নিজের মত ভণ্ড আর উজবুক মনে করে তার কর্মকাণ্ডকে বুজরুকি বলে মনে করেছিল। তাই, বদ্ধ মুষ্ঠি খুলে নিজের বিপদ নিজেই ডেকে এনেছিল।
Sir apner story amar kub vlolaglo, hii ami suman amader nijader golper 1ta channel a6a sir, apner satha ki6u kotha6ilo sir , apni jdi time kora amader satha kotha Bolen to kub vlohoi sir, amader channel ar jorno apner ki6u story darker sir ter jorno apner satha amra kotha bolta cai6i, sir pls accept my request, 8145306748 ata amar watsapp number apni amader satha contact korta caila amar ni number a message korben sir, Amadee channel ar name
” Golper Khelaghor”